শব্দ তরঙ্গ তৈরি করতে তার একটা উৎসের দরকার, সেটাকে পাঠানোর জন্য একটা মাধ্যমের দরকার এবং সেই শব্দ গ্রহণ করার জন্য কোনো এক ধরনের রিসিভার দরকার। আমাদের চারপাশে অসংখ্য শব্দের উৎস রয়েছে। অবশ্যই সবচেরে পরিচিত উৎস আমাদের কণ্ঠ, সেখানে যে ভোকাল কর্ড আছে আমরা তার ভেতর দিয়ে বাতাস বের করার সময় সেখানে যে কম্পন হয় সেটা দিয়ে শব্দ তৈরি হয়। কথা বলার সময় আমরা যদি গলায় স্পর্শ করি তাহলে আমরা সেই কম্পনটা অনুভব করতে পারব।
তোমরা নিশ্চয়ই লক্ষ করেছ পুরুষের গলার স্বর মোটা এবং নারী ও শিশুদের গলার স্বর তীক্ষ্ণ। আমরা যখন কোনো একটা শব্দ করি তখন আমাদের ফুসফুস থেকে বাতাস গলা দিয়ে দিয়ে বের হয়ে আসে। আমাদের গলায় ফুসফুসে বাতাস ঢোকার জন্য এবং বের হওয়ার জন্য রয়েছে wind pipe এর উপরে শব্দ সৃষ্টি করার জন্য রয়েছে স্বরযন্ত্র (Larynx)। সেখানে দুটো পর্দা ভালভের মতো কাজ করে, এই পর্দা দুটির নাম ভোকাল কর্ড (vocal cord)। বাতাস বের করার সময় এগুলো কাঁপতে পারে এবং শব্দ তৈরি করে। বয়সের সাথে সাথে পুরুষের ভোকাল কর্ড শক্ত হয়ে যায়, মেয়েদেরটি কোমল থাকে। সে জন্য পুরুষেরা কম কম্পাঙ্কের শব্দ তৈরি করে মেয়েরা বেশি কম্পাঙ্ক তৈরি করে। যে কারণে পুরুষের পলার স্বর মোটা মেয়েদেরটি তীক্ষ্ণ।
আমাদের কণ্ঠ ছাড়াও স্পিকার শব্দের উৎস হিসেবে কাজ করে, সেখানে যে পাতলা ডায়াফ্রাম রয়েছে সেটিকে সুনির্দিষ্টভাবে কাঁপিয়ে শব্দ তৈরি করা হয়। স্কুলের ঘন্টার মাঝে আঘাত করলে সেটি কাঁপতে শুরু করে শব্দ তৈরি করে এবং তখন হাত দিয়ে সেটাকে চেপে ধরে কম্পন বন্ধ করে ফেলা যায়, সাথে সাথে শব্দও বন্ধ হয়ে যাবে। গিটারের তারে ঠোকা দিলে সেটি কাঁপতে থাকে এবং শব্দ তৈরি করে। ল্যাবরেটরিতে সুর শলাকা দিয়ে নির্দিষ্ট কম্পনে শব্দ তৈরি করা যায়।
কম্পন দিয়ে শব্দ তৈরি করার পর সেটিকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পাঠানোর জন্য একটা মাধ্যমের দরকার হয়। শব্দ তরল কিংবা কঠিন পদার্থের ভেতর দিয়েও পাঠানো যায় কিন্তু আমরা বাতাসকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেই শব্দ শুনে অভ্যস্ত। মাধ্যম ছাড়া যে শব্দ যেতে পারে না সেটি দেখানোর জন্য ল্যাবরেটরিতে 7.02 চিত্রে দেখানো উপায়ে একটা জারে কলিং বেল রেখে সেটাকে বাইরে থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে বাজানো যেতে পারে। তারপর একটা পাম্প দিয়ে ধীরে ধীরে বায়ুশূন্য করা শুরু করলে কলিং বেলের শব্দ মৃদু হতে শুরু করবে। বেলজারটি পুরোপুরি বায়ুশূন্য করা হলে ভেতরে কলিং বেলটি বাজতে থাকলেও বাইরে থেকে মনে হবে সেটি কোনো শব্দ তৈরি করছে না।
আমরা আমাদের কান দিয়ে শব্দ শুনতে পাই। শব্দের কম্পাঙ্ক যদি 20 Hz থেকে 20,000 Hz বা 20Hz এর মাঝখানে থাকে তাহলে সেই শব্দ শোনা যায়। (তবে কানে হেডফোন লাগিয়ে অবিরত পান শুনে কিংবা প্রচণ্ড শব্দদূষণে থাকলে অনেক সময় শোনার ক্ষমতা কমে যায়।) শব্দের কম্পাঙ্ক 20 Hz থেকে কম হলে সেটাকে শব্দের বা ইনফ্রাসাউন্ড এবং 20kHz থেকে বেশি হলে সেটাকে শব্দোত্তর বা আলট্রাসাউন্ড বলে। 20 Hz থেকে কম কিংবা 20 kHz থেকে বেশি কম্পাঙ্ক তৈরি করা হলে সেটি বাতাসে যে আলোড়ন সৃষ্টি করবে আমরা সেটি শুনতে পারব না। এ ধরনের শব্দের অস্তিত্ব বুঝতে হলে আমরা বিশেষ ধরনের মাইক্রোফোন বা রিসিভার ব্যবহার করতে পারি। অনেক পশুপাখি কম কম্পাঙ্কের শব্দ শুনতে পায়। ভূমিকম্পের আগে আগে এ ধরনের কম কম্পাঙ্কের শব্দ তৈরি হয় এবং অনেক সময় পশুপাখি সেই শব্দ শুনে অভিে ছোটাছুটি করেছে সে ধরনের ঘটনা ঘটেছে বলে জানা গেছে।
শব্দ একটি যান্ত্রিক তরঙ্গ কারণ বস্তুর কম্পনের ফলে শব্দ তরঙ্গ সৃষ্টি হয় এবং সেটি সঞ্চালনের জন্য স্থিতিস্থাপক মাধ্যমের দরকার হয়। এটি একটি অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ কারণ এই তরঙ্গের প্রবাহের দিক এবং কম্পনের দিক এক। শব্দ তরঙ্গের বেগ মাধ্যমের প্রকৃতির উপর নির্ভর করে, বায়বীয় মাধ্যমে এর বেগ কম, ভরলে তার চেয়ে বেশি, কঠিন পদার্থে আরো বেশি। শব্দের বেগ মাধ্যমের তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতার উপরও নির্ভর করে। শব্দের তীব্রতা অন্যান্য তরঙ্গের মতো তার বিস্তারের বর্গের সমানুপাতিক। অর্থাৎ তরঙ্গের বিস্তার বেশি হলে শব্দের তীব্রতা বেশি হবে এবং তরঙ্গের বিস্তার কম হলে শব্দের তীব্রতা কম হবে। যেকোনো তরঙ্গের মতোই শব্দ তরঙ্গের প্রতিফলন, প্রতিসরণ এবং উপরিপাতন হতে পারে।
শব্দ যেহেতু এক ধরনের তরঙ্গ তাই তার প্রতিফলন হতে পারে। সাধারণত বড় ফাঁকা দালানের ভেতর কথা বললে এক ধরনের গমগম আওয়াজ হয়, সেটি প্রতিফলন ছাড়া আর কিছু নয়। দালানের ভেতর দূরত্ব বেশি নয় বলে শব্দটা আলাদাভাবে শুনতে পাই না। আমরা যখন কিছু শুনি তার অনুভূতিটা 0.1s পর্যন্ত থেকে যায় তাই দুটি শব্দ আলাদাভাবে শুনতে হলে দুটি শব্দের মাঝে কমপক্ষে 0.1s এর একটা ব্যবধান থাকা দরকার। শব্দের বেগ 330 m/s কাজেই 0.1s এর ব্যবধান তৈরি করতে শব্দকে কমপক্ষে 33 m দূরত্ব অতিক্রম করতে হয়। একটি বড় দেয়াল, দালান কিংবা খাড়া পাহাড়ের সামনে কমপক্ষে এই দূরত্বের অর্ধেক দূরত্বে ( 16.5m) দাঁড়ালে শব্দটি গিয়ে প্রতিফলিত হয়ে ফিরে আসতে 0.1s সময় লাগবে এবং আমরা শব্দের প্রতিধ্বনি শুনতে পাব।
বাদুড়ের চোখ আছে এবং সেই চোখে বেশ ভালো দেখতে পায়, তারপরও তারা ওড়ার সময় শব্দের প্রতিধ্বনি ব্যবহার করে। বাদুড় গুড়ার সময় তার কণ্ঠ থেকে শব্দ তৈরি করে, সামনে কোনো কিছু থাকলে শব্দটি সেখানে প্রতিফলিত হয়ে ফিরে আসে, কতক্ষণ পর শব্দটি ফিরে এসেছে সেখান থেকে বাদুড় দূরত্বটা অনুমান করতে পারে। এ জন্য অন্ধকারেও বাদুড় কোথাও ধাক্কা না খেয়ে উড়ে যেতে পারে। বাদুড়ের তৈরি এই শব্দ আমরা শুনতে পাই না, কারণ শব্দটি আলট্রাসাউন্ড অর্থাৎ আমাদের শোনার বাইরের কম্পাঙ্কের শব্দ। বাদুড় প্রায় 100 kHz কম্পনের শব্দ তৈরি করতে পারে।
বাতাসে শব্দের বেগ তাপমাত্রার বর্গমূলের সমানুপাতিক। অর্থাৎ
এখানে তাপমাত্রা কিন্তু সেলসিয়াস তাপমাত্রা হয়। কেলভিন স্কেলে তাপমাত্রা শব্দের বেগ বাতাসের চাপের ওপর নির্ভর করে না। তবে বাতাসের ঘনত্বের বর্গমূলের ওপর ব্যস্তানুপাতিকভাবে নির্ভর করে। তাই বাতাসে জলীয়বাষ্প থাকলে বাতাসের ঘনত্ব কমে যায়, সে জন্য শব্দের বেগ বেড়ে যায়।
শব্দ একটি যান্ত্রিক তরঙ্গ। এটি মাধ্যমের স্থিতিস্থাপকতার ওপর নির্ভর করে। তরল এবং কঠিন পদার্থের প্রকৃতি বাভাস থেকে ভিন্ন এবং স্বাভাবিক কারণেই শব্দের বেগ সেখানে ভিন্ন। তরলে শব্দের বেগ বাতাস থেকে বেশি এবং কঠিন পদার্থে শব্দের বেগ তরল থেকেও বেশি। 7.01 টেবিলে বিভিন্ন মাধ্যমে শব্দের বেগ দেখানো হয়েছে।
মাধ্যম | m/s |
বাতাস | 330 |
হাইড্রোজেন | 1,284 |
পারদ | 1,450 |
পানি | 1,493 |
লোহা | 5,130 |
হীরা | 12,000 |
শব্দের প্রচলিত ব্যবহারের কথা নিশ্চয়ই আর কাউকে আলাদা করে বলতে হবে না, আমরা কথা বলি, গান শুনি, ডাক্তাররা হৃৎস্পন্দন শোনেন, ইঞ্জিনিয়াররা যন্ত্রপাতির শব্দ শোনেন ইত্যাদি ইত্যাদি। শব্দের আরো কিছু ব্যবহার আছে, যার কথা তোমরা হয়তো শোনোনি। সন্তানসম্ভবা মায়ের গর্ভে যে নবজাতকটি বড় হয় বাইরে থেকে তাকে দেখার কোনো উপায় ছিল না, এখন আলট্রাসনোগ্রাফি নামে একটি প্রক্রিয়ায় সেটি দেখা সম্ভব হয়। শেষ অধ্যায়ে সেটি আলোচনা করা হয়েছে।
মাটির নিচে গ্যাস বা তেল আছে কি দেখার জন্য সিসমিক সার্ভে করা হয়। এটি করার জন্য মাটির খানিকটা নিচে ছোট বিস্ফোরণ করা হয়, বিস্ফোরণের শব্দ মাটির নিচের বিভিন্ন স্তরে আঘাত করে প্রতিফলিত হয়ে উপরে ফিরে আসে। জিওফোন (Geophone) নামে বিশেষ এক ধরনের রিসিভারে সেই প্রতিফলিত তরঙ্গকে ধারণ (Detect) করা হয়। সমস্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে মাটির নিচের নিখুঁত ত্রিমাত্রিক ছবি বের করে কোথায় গ্যাস বা কোথায় তেল আছে তা বের করে নেওয়া হয়। শব্দের উৎসটি কোথায় আছে এবং জিওফোন কোথায় আছে দুটিই জানা থাকার কারণে উৎস থেকে জিওফোনে শব্দ আসতে কতটুকু সমর লেগেছে জানতে পারলেই বিভিন্ন স্তরের দূরত্ব নিখুঁতভাবে বের করা যায়।
ল্যাবরেটরিতে যখন ছোটখাটো যন্ত্রপাতি নিখুঁতভাবে পরিষ্কার করতে হয় তখন আলট্রাসাউন্ড ক্লিনার ব্যবহার করা হয়। এখানে কোনো একটি তরলে ছোটখাটো যন্ত্রপাতি ডুবিয়ে রেখে তার ভেতর আলট্রাসাউন্ড পাঠানো হয়, তার কম্পনে যন্ত্রপাতির সব ময়লা বের হয়ে আসে।
আমাদের চারপাশে নানা ধরনের শব্দ রয়েছে তার মাঝে কিছু কিছু শব্দ শুনতে আমাদের ভালো লাগে আবার কিছু কিছু শুনতে আমাদের ভালো লাগে তার মাঝে সবচেয়ে প্রধান হচ্ছে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের শব্দ।সুরশলাকা বা টিউনিং কর্ক থেকে নিখুঁত একটি কম্পনের শব্দ বের হয়। কিন্তু সুরযুক্ত শব্দে শুধু একটি তরঙ্গ থাকে না, একাধিক তরঙ্গ পরস্পরের ওপর উপস্থাপন করে শব্দটাকে সুরেলা করে তোলে।
সুরেলা শব্দকে ব্যাখ্যা করার জন্য অনেকগুলো বৈশিষ্ট্য সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে তার মাঝে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি হচ্ছে
তীব্রতা (Intensity): একটি সুরেলা শব্দ কত জোরে শোনা যাচ্ছে তার পরিমাণ হচ্ছে তীব্রতা। অর্থাৎ একক ক্ষেত্রফল দিয়ে প্রতি সেকেন্ডে যে পরিমাণ শব্দ শক্তি যায় তাকে শব্দের তীব্রতা বলে। শব্দের তীব্রতার একক হচ্ছে
তীক্ষ্ণতা (Pitch): সুরযুক্ত শব্দের যে বৈশিষ্ট্য দিয়ে একই তীব্রাকার শব্দকে কখনো মোটা কখনো তীক্ষ্ণ শোনা যার তাকে তীক্ষ্ণতা বা পিচ বলে। তীক্ষ্ণতার একক হচ্ছে Hz।
টিম্বার (Tibre): ভিন্ন ভিন্ন বাদ্যযন্ত্র থেকে আসা শব্দের পার্থক্য যে বৈশিষ্ট্য দিয়ে বোঝা যায় সেটা হচ্ছে টিম্বার বা সুরের গুণ।
সুরেলা শব্দ তৈরি করার জন্য নানা ধরনের বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার করা হয়, সেগুলোকে মোটামুটি তিন ভাগে ভাগ করা যায় :
তার দিয়ে তৈরি বাদ্যযন্ত্র: একতারা, বেহালা, সেতার
বাতাসের প্রবাহ দিয়ে তৈরি বাদ্যযন্ত্র: বাঁশি, হারমোনিয়াম
আঘাত (Percussion) দিয়ে শব্দ তৈরি করার বাদ্যযন্ত্র: ঢোল, তবলা
আজকাল ইলেকট্রনিকস ব্যবহার করে সম্পূর্ণ ভিন্ন উপায়ে সুরেলা শব্দ তৈরি করা হয়।
জীবনের অনেকটুকুর গুরুত্বটুকু ধরতে পারি । এটি বলার অপেক্ষা রাখে না শব্দদূষণের কারণে আমাদের শোনার ক্ষমতার অনেক ক্ষতি হয়। সমস্যাটি বাড়িয়ে তোলার জন্য আমাদের অনেকে অপ্রয়োজনেও কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শোনে।
শব্দদূষণ কমানোর জন্য প্রথম প্রয়োজন দেশে এর বিরুদ্ধে আইন তৈরি করা যেন কেউ শব্দদূষণ করতে না পারে এবং করা হলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যায়। এরপর প্রয়োজন জনসচেতনতা। সবাইকে বিষয়টি বোঝাতে হবে, যথাসম্ভব কম হর্ন ব্যবহার করে চলাচল, কলকারখানায় শব্দ শোষণের যন্ত্র চালু, মাইকের ব্যবহার কমিয়ে কিংবা বন্ধ করে দেওয়া, কম শব্দের যানবাহন ব্যবহার ইত্যাদি। একই সাথে শহরের ফাঁকা জায়গায় প্রচুর গাছ লাগিয়ে শব্দকে শোষণ করার মতো ব্যবস্থাও নেওয়া উচিত।
জেট ইঞ্জিন |
110-140 db |
ট্রাফিক |
80-90 db |
গাড়ি |
60-80 db |
টেলিভিশন |
50-60 db |
কথাবার্তা |
40-50 db |
নিঃশ্বাস |
10 db |
মশার পাখার শব্দ |
0 db |
Read more